Thursday, October 16, 2014

ভাষা-মতিনের কি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রাপ্য ছিল না?

*#ভাষা-মতিনের কি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রাপ্য ছিল না?*

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটির কারণে গত সপ্তাহে লিখতে পারিনি। ঈদুল আজহার ঠিক দুই দিন পর গত ৮ অক্টোবর এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানী আবদুল মতিন। আবদুল মতিনকে শুধু একজন ভাষাসৈনিক বললে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। কঠিন বাস্তবতার বিচারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভাষা আন্দোলনের দুঃসাহসী সেনাপতি। ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তির প্রতীক ভাষা মতিন।
আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম এবার লিখব ভাষা মতিনকে নিয়ে। কিন্তু তখনও কল্পনা করতে পারিনি এ লেখা শুরু করতে হবে একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে। আমরা সকলেই বলে থাকি, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই দেশে স্বাধীনতার চেতনা গড়ে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফসল হিসেবেই উপমহাদেশে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। সেই নিরিখে ভাষাসৈনিকরাই স্বাধীন বাংলাদেশের মূল স্থপতি। সেই স্থপতিদের যিনি মধ্যমণি সেই ভাষা মতিনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জুটল না, এর চাইতে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে! ভাষা আন্দোলনের এ দুঃসাহসী সেনাপতিকে অবজ্ঞা করে সরকার সমগ্র জাতিকেই অপমানিত করেছে। এ অনুভূতি শুধু আমার একার নয়, সকল ভাষাসৈনিকই এতে ক্ষুব্ধ, মর্মাহত হয়েছেন। অনেক ভাষাসৈনিকের এ ক্ষোভ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এসব সমালোচনার জবাব দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ হতে যেভাবে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে তাতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার চাইতেও অনেক বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সকলেই বুঝবেন, এটা কোন জবাব নয়, জবাব এড়ানোর কৌশল মাত্র। সরকারের পক্ষ হতে হয়তো বলা হবে ভাষা মতিনের মৃত্যুতে দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, এটাও এই কিংবদন্তি ভাষাসৈনিকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা  না দানের  আরেকটি অজুহাত।
আমরা বুঝি না, যে ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি বিবেচনা করা হয়, সেই ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষনা দেন তার মুখের ওপরে ‘নো-নো’ বলে যে ভাষা মতিন প্রতিবাদ জানান, স্বাধীন বাংলাদেশে তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জোটে না, অথচ কায়দে আজমের ঐ বক্তৃতার পরও তদানীন্তন সরকারি-বেসরকারি পত্রিকায় যে কবি কায়দে আজমের প্রশস্তি গেয়ে প্রচুর কবিতা লেখেন, তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেতে কোনো অসুবিধা হয় না কিভাবে! মরহুম মতিনের সম্ভবত একটা ‘অপরাধ’ ছিল। তিনি বর্তমান শাসক দলের অনেক কিছু সমর্থন করলেও সরকারের অন্যায় কাজের কঠোর সমালোচনা করতে দ্বিধা করতেন না। শাসক দলের অন্ধ সমর্থক না হওয়ার কারণে যদি তাকে তার প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয় তার চাইতে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে।
এবার মূল প্রসঙ্গ। জন্ম তাঁর বৃহত্তর পাবনা জেলায়। ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। কৃষিজীবী পিতা আবদুল জলিলের পুত্র তিনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সাথে এমনভাবেই জড়িয়ে পড়েন যে, তার অন্যান্য পরিচয় গৌণ হয়ে গিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘ভাষা মতিন’। ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি পুরুষ এই আবদুল মতিন ওরফে ভাষা মতিন দীর্ঘদিন নানা রোগ ভোগের পর গত ৮ অক্টোবর বুধবার সকাল ৯টায় রাজধানীর  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। সে নিরিখে তাঁর এ মৃত্যুকে কোনোভাবেই অকাল মৃত্যু বলা যাবে না। তবুও কিংবদন্তি পুরুষের এ মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে  মেনে নিতে, আমরা যারা তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলাম- তাদের কাছে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবে কোনো মানুষের পক্ষে একবার জন্মগ্রহণের পর সব চাইতে কঠিনতম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় তার মৃত্যু। জন্মের পর কে কতদিন বেঁচে থাকবে, কত ধন-সম্পদের অধিকারী হবে, কতটুকু শিক্ষিত হবে, জীবনে কতটা খ্যাতি বা ক্ষমতার অধিকারী হবে- কিছুই জোর দিয়ে বলা যায় না। নিশ্চিত করে বলা যায় শুধু একটি কথা : সে একদিন মৃত্যু বরণ করবে। এ সুন্দর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে একদিন তাকে চলে যেতে হবে না ফেরার দেশে।
আবদুল মতিনকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। তিনি আমাদের দেশের হিসাবে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। ৮৮ বছরের এ সুদীর্ঘ জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে তিনি অবশ্য বেশ কিছুদিন বার্ধক্যজনিতসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। নইলে তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের সিংহভাগই ছিল কর্মমুখর। তাঁর দীর্ঘ জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি অবশ্য-ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ। ভাষা আন্দোলনে আরও অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি আরও অনেক কাজে তারা সক্রিয় ছিলেন। তার মতো এত গভীর আবেগ নিয়ে ভাষা আন্দোলনে আর কেউ সম্ভবত অংশগ্রহণ করেননি। ফলে দেশে আরো বহু ভাষাসৈনিক থাকলেও ভাষা মতিন হয়ে উঠেছিলেন শুধু একজনই।
আগেই বলেছি, আবদুল মতিন জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালে। আমার জন্ম ১৯২৯ সালে। সেই হিসাবে তিনি আমার চাইতে তিন বছরের বড় ছিলেন। বয়সের ব্যবধান ছাড়াও তার সাথে আদর্শিক চিন্তাধারার দিক দিয়েও আমার ছিল পার্থক্য। তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। আর আমার আস্থা সাম্য-ভ্রাতৃত্বের বিশ্বজনীন আদর্শ ইসলামে। কিন্তু বয়স ও আদর্শের এ পার্থক্য কোনো দিন আমাদের ঘনিষ্ঠতাকে ক্ষুণœ করতে পারেনি। যখন তমদ্দুন মজলিসের কোনো আলোচনা সভায় তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, বার্ধক্যজনিত কারণে অক্ষম না হয়ে পড়া পর্যন্ত কখনোই তিনি আমন্ত্রণে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করেননি।
ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে তাঁর সাথে আমার গড়ে উঠেছিল আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা। আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি, তিনি যখন যা চিন্তা করতেন অকপটে তা প্রকাশ করতেন। তার এসব অকপট বক্তব্যে কে কি মনে করবে, কার মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হবে তার পরোয়া তিনি করতেন না। এ কারণে বামপন্থী চিন্তাধারার লোক হয়েও তার সাথে অন্যান্য বামপন্থীদের একটা পার্থক্য ছিল। জীবনের শেষ দিকে বামপন্থী রাজনীতিকদেরও তিনি মাঝে মাঝে সমালোচনা করতেন এই বলে যে, তারা সমাজের বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম বলেই দেশে বামপন্থী আন্দোলন জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভে জোরদার হয়ে উঠতে পারছে না।
নিজ বিশ্বাসে সবসময় অটল থাকলেও অন্যান্য আদর্শ ও চিন্তাধারার লোকদের সাথে অভিন্ন কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে কাজ করতে তার মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোনো বড় কাজ করতে গেলে জনগণের বৃহত্তর অংশের সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। সম্ভবত এ কারণেই তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে তার একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং এ সম্পর্ককে তিনি যথেষ্ট মূল্য দিতেন।
তবে তিনি মাঝেমধ্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলতেন, তমদ্দুন মজলিস যদি ভাষা আন্দোলন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করত তবে আরো ভালো হতো। তাঁর একথা বলার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। ইসলামী আদর্শের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অনুপ্রাণিত ছিলেন বলেই সেদিন হয়তো আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কিন্তু আজ ভিন্ন অবস্থা। আব্দুল মতিন যাঁর কাছ থেকে এ ধরাধামে এসেছিলেন, মৃত্যুর পর এখন পুনরায় সেই আল্লাহ তায়ালার কাছেই ফিরে গেছেন। শুধু আবদুল মতিন নন, সকল মানুষের জন্যই এটা বাস্তবতা। শুধু আবদুল মতিন নন, কোন মানুষই সার্বভৌম নন। সার্বভৌম তাকেই বলে, যার ইচ্ছা প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো নেই। মানুষ সার্বভৌম নয়, কারণ তার ইচ্ছা বা শক্তির সীমাবদ্ধতা আছে। জন্মগ্রহণের পর কে না চায় পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। তাই অসুস্থ হলে আমরা মৃত্যু ঠেকাতে চিকিৎসা করাই। একশ’ বছরের বৃদ্ধ হলেও আমরা চাই আরও যতদিন সম্ভব বেঁচে থাকতে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- কুল্লু নাফছিন জায়েকাতুল মাউত- জীব মাত্রেরই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। মানুষ সে যত বুদ্ধি, সম্পদ বা ক্ষমতার অধিকারীই হোক, একদিন না একদিন তাকে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতেই হবে। আর মৃত্যুর পরই যে তার জীবনের ইতি হয়ে যাবে, তা নয়। পার্থিব জীবনের ওপারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরেক জীবন। সে জীবনে আমাদের পার্থিব জীবনের কর্মকান্ডের ফলাফল ভোগ করতে হবে। কৃষক জমিতে যেমন আবাদ করে পরবর্তীতে তেমনি ফসল তোলে সে। তেমনি মানুষ পার্থিব জীবনে স্রষ্টার বিধান যতটা পালন করে, ততটাই সে তার সুফল পায় পরকালে। আর স্রষ্টার বিধান এ জীবনে যে যতটা অমান্য করে, সে তার জন্য ততটা শাস্তি ভোগ করে পরকালে। এর কোন অন্যথা নেই।
অন্যথা নেই বলেই মানুষ সার্বভৌম নয়। সার্বভৌম একমাত্র মহান স্রষ্টা। তাঁর কাছ থেকেই আমরা এ পৃথিবীতে আসি আর মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাই। আর যেহেতু মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা পরজীবনে চলে যাই, তাই মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের জীবনের সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। মৃত্যুর মাধ্যমে এ জীবন থেকে অন্য জীবনে আমাদের স্থানান্তর ঘটে বলেই মৃত্যুর অন্য নাম ‘ইন্তেকাল’ তথা জীবনান্তর। বেঁচে থাকতে আমরা অনেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে না পারলেও মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতার মাধ্যমে আমরা আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং আল্লাহর ক্ষমতার সীমাহীনতা তথা তাঁর সার্বভৌমত্বের তাৎপর্য ঠিকই উপলব্ধি করতে পারি। উপলব্ধি করতে পারলেও নিজের জন্য তখন আর কিছু করার উপায় থাকে না।
মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির শান্তি ও কল্যাণের জন্য কিছু করার থাকে শুধু মৃত ব্যক্তির আপনজনদের। এটা অন্যদের জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের জন্যও। আমরা যারা আবদুল মতিনের ভক্ত ও অনুরক্ত, আমাদের উচিত হবে তার পরলোকগত আত্মার শান্তির জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করা। তা না করে আমরা যদি শুধু তার গুণ কীর্তন করে আমাদের কর্তব্য সমাধা করি, তাঁর কোনো উপকারে আসবে না। মানুষের জীবনে ভালোমন্দ দুইই থাকে। বহু ভালো কাজের পাশাপাশি সবার জীবনেই ভুল-ত্রুটি থাকে। আমরা যাঁর সৃষ্টি, মৃত্যুর পর যেহেতু পুনরায় তাঁর কাছেই চলে যাই, মৃত ব্যক্তির জীবনের যাবতীয় ভুল ত্রুটির জন্য পরম স্রষ্টার কাছে ক্ষমা প্রার্থনাই হবে তার আপনজনদের প্রধান কর্তব্য। আমরা যারা আবদুল মতিনের পরলোকগত আত্মার সত্যিকার শান্তি চাই, তারা আসুন সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার কাছে তার হয়ে তার জীবনের সকল ভুলত্রুটির জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
-See more at: http://www.dailyinqilab.com/2014/10/16/212178.php#sthash.p2KddVin.WhmCBrKF.dpuf